মফস্‌সল শহরগুলোতে কেন বইমেলা হবে না

১.

চিলমারী। ঢাকা থেকে পৌঁছাতে ১৩ ঘণ্টা লাগে। সেখানে ১ মার্চ থেকে পাঁচ দিনব্যাপী পণ্ডিত বইমেলা হয়ে গেল। এ বছর উদ্বোধক ছিলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও লেখক হিসেবে পাঠকের মুখোমুখি হয়েছিলেন মাহবুব মোর্শেদ। গত বছর উদ্বোধক ছিলেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, তার আগের বছর গল্পকার মঈনুল আহসান সাবের। প্রথম বছর ছিলেন আনিসুল হক। প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকছেন সব দলের বা দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বরা। যাঁদের ছবি বইমেলার প্রাঙ্গণে রাখা হয়েছে, তাঁরা হলেন সৈয়দ শামসুল হক, চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন, ভাওয়াইয়া শিল্পী কছিম উদ্দীন, সফিউল আলম রাজা ও জাহিদ হাসান রাজা।

সরকারের বা প্রশাসনের কোনো ব্যক্তি এখানে উদ্বোধক বা প্রধান অতিথি নন। দলীয় ব্যক্তিরা দু–একজন ছাড়া সবাই বাধা দেওয়ার বদলে সহযোগিতা করছেন। কীভাবে দল-মতনির্বিশেষে সবার বইমেলা এটি হয়ে উঠেছে? যেখানে জেলা শহর কুড়িগ্রামে তিন বছর ধরে বইমেলা হয় না, সেখানে কীভাবে প্রত্যন্ত চিলমারীতে সম্ভব হচ্ছে?

২.

জেলাগুলোর একেকটাতে গড়ে ২৫ লাখ লোকের বাস। ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রেও এত জনসংখ্যা নেই। জেলাগুলোর সম্পদ যদি জেলাতেই থাকত, যদি জ্ঞানচর্চার পরিবেশ থাকত, তবে জেলাগুলোতেই প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ হতো। জনগণের অফুরন্ত সৃজনী শক্তি টের পাওয়া যেত। জেলাতেই হাজার হাজার বই প্রকাশিত হতো। কুড়িগ্রাম জেলার গড়ে প্রতিটা ইউনিয়নে একাধিক পাঠাগার আছে। কিন্তু সেই পাঠাগারগুলো বইয়ে ভর্তি হয়ে উঠত। স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজগুলোর লাইব্রেরিগুলোতে বই থাকত। ইদানীং বই লাইব্ররিকেন্দ্রিক হওয়ার বদলে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত হয়ে উঠছে। তখন জেলাগুলোতে ৫০ থেকে ৬০টি করে বইয়ের দোকান থাকার কথা। মানসিক স্বাস্থ্য যে এ দেশবাসীর তলানিতে, তা কি এমনি? ২৫ লাখ মানুষ কী পড়বে, বইয়ের চাহিদা কীভাবে পূরণ হবে, সেই চিন্তা থাকতে পারত উপজেলা ও জেলার চেয়ারম্যানদের। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে স্থানীয় সরকার না থাকা ও নির্বাচনী ব্যবস্থা ঠিক না হওয়ায় উপজেলা ও জেলাগুলো সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র হয়ে আছে মাত্র। তাদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক নেই।

পৌর কর্তৃপক্ষ জায়গা পেলেই মার্কেট বানাচ্ছে, কিন্তু একটা দোকান বইয়ের জন্য বরাদ্দ রাখছে না। ভবনের অনুমতি দিচ্ছে, কিন্তু গ্যারেজে বুক কর্নার রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসাবিষয়ক বইয়ের কর্নার থাকতেই পারত। ওষুধের দোকানে স্বাস্থ্যবিষয়ক বই থাকলে শুধু ওষুধই নয়, স্বাস্থ্যবিষয়ক বইও বিকোবে। কৃষি অফিসের ভবনগুলোতে কৃষিবিষয়ক, প্রকৌশল অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পাট, সেচ, বিআইডব্লিউটিএ অফিসগুলোতে সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা নিয়ে সমৃদ্ধ কর্নার থাকতে পারত। প্রতিটি রেলস্টেশনে একটি করে থাকতে পারত। আহমদ ছফা যে বলতেন, বাংলা ভাষায় কোনো একটা বিষয়েও আধা ডজন বইও পাওয়া যায় না, তা কি তখন হতো?

৩.

যে মানুষ মানুষকে সম্মান করতে পারে না, সে মানুষকে মানুষ উপকার করতে অক্ষম।…শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে, এ জন্য কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম। শুধু শ্বেত-রাশিয়ার জন্যই নয়, মধ্য এশিয়ার অর্ধ-সভ্য জাতের মধ্যেও তারা বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করে চলেছে—সায়েন্সের শেষ ফসল পর্যন্ত যাতে তারা পায় এই জন্য প্রয়াসের অন্ত নেই। এখানে থিয়েটারে অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে তারা কৃষি ও কর্মী দলের। কোথাও এদের অপমান নেই। ইতিমধ্যে এদের যে দুই-একটি প্রতিষ্ঠান দেখলুম, সর্বত্রই লক্ষ্য করেছি, এদের চিত্তের জাগরণ এবং আত্মমর্যাদার আনন্দ।—কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেছেন।

চিলমারীর দেখাদেখি কুড়িগ্রামেও ১২ মার্চ থেকে নাগরিকদের উদ্যোগে বইমেলা শুরু হচ্ছে। কেমনে সম্ভব হচ্ছে? কারণ, এখনো সমাজ টিকে আছে। সমাজের মধ্যে গুণীর কদর আছে, বইয়ের প্রতি ভক্তি আছে। এখানে পুলিশ ছাড়াই নারী-পুরুষ একসঙ্গে গান শোনে, পরিচালক খন্দকার সুমনের উপস্থিতিতে লাইট নিভিয়ে নির্বিঘ্নে ‘সাঁতাও’ সিনেমা দেখে। এটাই হলো সমাজের শক্তি। মুক্তিযুদ্ধও ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমাজেরই লড়াই। শিক্ষক যখন বলে ওঠেন, ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার,/ দিল্লীপতি সে তো কোন ছাড়’—তখন আসলে সমাজ নিজেকে রাষ্ট্রশক্তির ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। মফস্‌সলে এখনো সমাজ আছে, সেখানে রাষ্ট্রশক্তির বদলে সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। বইমেলাতেও আসতে হবে। এই শক্তির জাগরণ ছাড়া বইমেলা কেন, বাংলাদেশই নতুনভাবে জন্ম নেবে না।